আবদুল আজিজ,বাংলা ট্রিবিউন :
আমরা যাবো না। আমাদের কোথায়, কীভাবে নিয়ে যাচ্ছে সেটি না জানা পর্যন্ত ফিরে যাবো না। প্রয়োজনে এখানে (বাংলাদেশে) বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করবো। মিয়ানমার আমাদের মেরে ফেলবে। আমরা নির্যাতিত দেশে ফিরতে চাই না’
কথাগুলো বলছিলেন কক্সবাজারের উখিয়ার থাইংখালী জামতলী জি-৮ ব্লকে অবস্থানরত প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম ওঠা রোহিঙ্গা নারী হামিদা খাতুন (৫৫)।
আজ বৃহস্পতিবার (১৫ নভেম্বর) থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে ৩০টি পরিবারের ১৫০ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। দুপুরে প্রথম দল হিসেবে এই রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার সরকারের কাছে হস্তান্তর করার কথা থাকলেও বৃহস্পতিবার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা হবে কিনা, তা নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেন না শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়।
তবে প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা রোহিঙ্গারা বলছেন, মিয়ানমারে চলে যেতে হবে এ বিষয়টি জানানো হলেও কোথায় ও কীভাবে তাদের নিয়ে যাওয়া হবে, তা তারা জানেন না।
প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৪ আগস্ট নিরাপত্তা বাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর রাখাইনে পূর্ব পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। নিপীড়নের মুখে গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এর আগে থেকে আশ্রয় নেওয়াসহ ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি ক্যাম্পে অস্থায়ীভাবে অবস্থান করছে। এই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে গত ২০১৭ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দুই দেশের সমন্বয়ে গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করা হয়। স্মারকের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ মিয়ামারের কাছে আট হাজার রোহিঙ্গার তালিকা পাঠায়। যাচাই-বাছাই শেষে মিয়ানমার ওই তালিকা থেকে ৫ হাজার ৫শ’ জনকে প্রত্যাবাসনের ছাড়পত্র দেয়।
গত ৩০ অক্টোবর জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভায় প্রথম ধাপে ২ হাজার ২৫১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী, প্রতিদিন ফেরত নেওয়া হবে ১৫০ জন রোহিঙ্গাকে। প্রথম ধাপের প্রত্যাবাসন কার্যক্রম আজ ১৫ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। প্রত্যাবাসনের জন্য টেকনাফের কেরুনতলী ট্রানজিট ক্যাম্প প্রস্তুত করা হয়েছে। অন্যদিকে, বান্দরবানের ঘুমধুমে আরও একটি ট্রানজিট ক্যাম্প প্রায় সম্পন্নের পথে।
এদিকে, প্রত্যাবাসনের জন্য তৈরি করা তালিকায় থাকা রোহিঙ্গারা জানান, মিয়ানমারের ফেরার বিষয়টি কিছু দিন আগে তারা জেনেছেন। তবে কীভাবে এবং কখন যেতে হবে, সে সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। মিয়ানমারের অবস্থান সম্পর্কেও ন্যূনতম ধারণা তাদের দেওয়া হয়নি। এ কারণে অনেকেই ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে গেছে। যতদিন পর্যন্ত মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, বসতভিটা, জমিজমা ফিরিয়ে না দেবে, ততদিন পর্যন্ত তারা মিয়ানমারে ফিরে যাবেন না।
কথা হয় উখিয়ার থাইংখালী জামতলী জি-৮ ব্লকে অবস্থানরত প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম ওঠা আবুল কালামের (৩৫) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার স্ত্রী ও চার মেয়ে রয়েছে। কিছু দিন আগে সরকারের পক্ষ থেকে ক্যাম্পে এসে আমাদের নাম ঠিকানা লিখে নিয়ে যাওয়া হয়। এর কয়েকদিন পর এসে বলে যে, আমাদের মিয়ানমার ফেরত যেতে হবে। এতে আমি ও আমার পরিবার দিশেহারা হয়ে পড়ি। রাতে দেখি আমার বউ ও মেয়ে কোথায় যেন পালিয়ে গেছে।’
শুধু আবুল কালাম ও হামিদা খাতুন নয়, প্রত্যাবাসন তালিকায় নাম উঠেছে জামতলী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের জি-৮ ব্লকের আলী আহমদ (৬০), কামাল হোসেন (৩৪) মোস্তফা খাতুন (৪৫) ও আনোয়ারা বেগম (৩০)-সহ অনেকের। তারা জানান, প্রত্যাবাসনের খবর পেয়ে পরিবারের অনেকেই এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে পালিয়ে গেছে। তাদের সাফ জবাব, মিয়ানমার ফিরে যাবে না।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার এবং জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, ‘প্রথমদিন ৩০ পরিবারের ১৫০ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। মিয়ানমার আমাদের জানিয়েছে, তারা যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। এমনকি প্রত্যাবাসনের সময় সেদেশের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীও উপস্থিত থাকতে পারেন।’
প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার দুপুরে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম প্রত্যাবাসন ঘাট দিয়ে তালিকাভুক্ত ৩০টি পরিবারের ১৫০ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের কথা রয়েছে। এজন্য সব ধরনের কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এখন শুধুমাত্র ইউএনএইচসিআর-এর সম্মতি পেলেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে।
প্রতিদিনের খবরগুলো আপনার ফেসবুক টাইমলাইনে পেতে নিচের লাইক অপশনে ক্লিক করুন-